দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নাভিশ্বাস!
৩০ নভেম্বর ২০১৯, ০৮:২৪
পিয়াজের বাজারে লাগা আগুন এখনো থামেনি। পিয়াজের দাম কমার আগেই চাল ও
ভোজ্যতেলের বাজারেও অস্থিরতা শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে খাদ্যমন্ত্রীর
বৈঠকের পরও দাম কমেনি। বরং খুচরা বাজারে কেজিতে চাল ও ভোজ্যতেলে ৩ থেকে ৮
টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ময়দার বাজারও অস্থির। বাজারে শীতকালীন সবজির সরবরাহ
বাড়লেও দাম এখনো ঊর্ধ্বমুখী। তাছাড়া ডাল, ডিম ও আদা-রসুনের দামও বাড়তি। ফলে
এসব খাদ্যপণ্য কিনতে চরম বিপাকে পড়েছেন সাধারণ ক্রেতারা। তাদের আয়ের একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে চাল-ডাল-শাকসবজিসহ নিত্যপণ্য কিনতে। সব
মিলিয়ে নিত্যপণ্যের চাহিদা মেটাতে গিয়ে নিম্নআয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি)
হিসাবে, গত বছর এ সময়ের তুলনায় প্রতিটি নিত্যপণ্যের দামই বেশ বাড়তি। গত বছর
এ সময় পিয়াজের কেজি ছিল ২০-৩৫ টাকা। আর বর্তমান বাজারে পিয়াজের কেজি
১৮০-২২০ টাকা। এদিকে মোটা চালের দামও গত এক মাসের ব্যবধানে প্রায় ৯ শতাংশ
বেড়েছে। আটা-ময়দার দামও বেড়েছে প্রায় ৮ শতাংশ। ভোজ্যতেলে দামও বেড়েছে ৮
শতাংশ। এছাড়া মসুরের ডালও বেড়েছে প্রায় ৩ শতাংশ।
বাজার পর্যলোচনায়
দেখে গেছে, ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠছে দ্রব্যমূল্যের বাজার। অল্প কয়েক
দিনের ব্যবধানে পিয়াজের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। যে পিয়াজ বিক্রি হতো ২০ টাকা
কেজিতে, তার দাম বেড়ে দাঁড়ায় ২৫০ টাকা। প্রধান খাদ্য চালের দামও বাড়ছে।
এদিকে
বৃহস্পতিবার গাজীপুরে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে এক কর্মশালায় কৃষিমন্ত্রী
মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ভারত যে এভাবে পিয়াজের উপর নিষেধাজ্ঞা দেবে এটা
আমরা বুঝতে পারিনি। এখানে হয়ত আমাদের ভুল থাকতে পারে। আগেই আমাদের
এসেসমেন্ট করা দরকার ছিল, জরিপ করা দরকার ছিল যে দেশে কত টন পিয়াজ উৎপাদন
হয়েছে। কতটা আমরা পিঁয়াজ আমদানি করব। পিয়াজ আমদানিটা একটা দেশের উপর নির্ভর
না করে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানির জন্য যোগাযোগ করা দরকার ছিল এবং সেটি
হয়নি বলে জানান রাজ্জাক।
এদিকে বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের
সামনে পিয়াজ-চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে বিক্ষোভ
ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে বাম গণতান্ত্রিক জোট ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স
পার্টি। সমাবেশে বক্তারা বলেন, ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে পিয়াজের দাম
বাড়িয়ে দিয়ে জনগণের পকেট থেকে তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। চালের
দাম কেজিপ্রতি আট থেকে ১০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। লবণের দাম নিয়ে কারসাজি করে
মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সরকারের লোকদেখানো
সক্রিয়তায় মানুষের আস্থা নেই।
পিয়াজসহ বেশ কিছু ভোগ্যপণ্যের দাম
বৃদ্ধি পাওয়ায় মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)
সর্বশেষ অক্টোবর মাসের মূল্যস্ফীতির তথ্য অনুযায়ী খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি
বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫.৫৬ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ৫.৪০ শতাংশ।
পিয়াজের দাম:
পিয়াজের দাম এখনো নাগালের বাইরে। বাজারভেদে দেশি পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২০০
থেকে ২৪০ টাকা কেজি দরে। মিয়ানমারের একটু ভালো মানের পিয়াজের কেজি ছিল ২০০
টাকা। আর চীন থেকে আমদানি করা পিয়াজ বিক্রি হয়েছে ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি
দরে। টিসিবির হিসাবে, গত বছর এ সময়ে পিয়াজের কেজি ছিল ২০ থেকে ৪০ টাকা। আর
বাজারে প্রতি কেজি রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায়। আদা বিক্রি হচ্ছে
১৪০ থেকে ১৬০ টাকা। এদিকে পিয়াজের বাজারে নৈরাজ্য চলার মধ্যেই তুলকালাম
হলো লবণের বাজারে। তবে এখন পণ্যটির বাজার স্থিতিশীল রয়েছে।
কাওরান
বাজারে পাল্লা হিসেবে (৫ কেজি) পিয়াজ বিক্রি করছিলেন পাইকারি বিক্রেতারা।
স্বদেশি বাণিজ্যালয়ের বিক্রেতা ইয়াসিন বললেন, দেশি পিয়াজের সরবরাহ কম। নতুন
পিয়াজ এখনো বাজারে পুরোপুরি আসতে শুরু করেনি। আগামী সপ্তাহে নতুন পিয়াজ
বাজারে এলে দাম কমতে পারে।
চালের দাম: মাসখানেক
ধরে সরু চালের দামও কেজিতে ৫ থেকে ৭ টাকা বাড়তি। চাল বিক্রেতা মো. মামুন
বলেন, চালের দাম এই সপ্তাহে নতুন করে আর বাড়েনি। ভালো নাজিরশাইল ৬৫ টাকা,
মিনিকেট ৫০ থেকে ৫২ টাকা আর একদম মোটা চাল ৩২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
ময়দা:
বাজারে প্রতি কেজি ময়দা বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়। যা কিছুদিন আগে বিক্রি
হয়েছে ৩২ টাকা। হঠাৎ করে বেড়েছে ময়দার দাম। প্রতি কেজি আটাতেও দাম বেড়েছে
দুই থেকে তিন টাকা। ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ার পেছনে কানাডা থেকে গম আমদানি কম
হওয়াকে দায়ী করেন। কানাডায় গমের দাম বেড়ে গেছে বলেও জানান ব্যবসায়ীরা।
অন্যদিকে
ডাল, ভোজ্যতেল ও ডিমের দামও বেড়েছে। দুই সপ্তাহ ধরে প্রতি কেজি মসুরের ডাল
(নেপালি) বিক্রি হচ্ছে ১২০-১২৫ টাকায়। যা আগে ১১৫ টাকা ছিল। সয়াবিন তেলের
দাম বেড়েছে লিটারে ৩ থেকে ৪ টাকা। ভোজ্যতেলের মধ্যে সয়াবিন তেল (পাঁচ
লিটারের বোতল) বিক্রি হচ্ছে ৪৮০ টাকায়, যা দুই সপ্তাহ আগে ৪৫০-৪৬০ টাকায়
বিক্রি হয়েছে। এছাড়া খোলা সয়াবিন প্রতিলিটার বিক্রি হয়েছে ৯০ টাকায়, যা দাম
বাড়ার আগে ৮৫ টাকায় বিক্রি হয়।
বাজারে ফার্মের মুরগির ডিমের ডজন
বিক্রি হয়েছে ১০৫ টাকায়। এক বছর আগে এই সময়ে ডিমের ডজন ছিল ৯০ টাকা। বছরের
ব্যবধানে মূল্য বেড়েছে ১৬ শতাংশ। গত সপ্তাহের তুলনায় কক জাতের মুরগির দাম
কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে এখন ২৬০ টাকা। তবে ব্রয়লার মুরগির দাম আগের মতোই ১২০
টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
শীতকালীন সবজি এলেও দাম বেশ চড়া:
কাওরান বাজারসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে শীতকালীন সবজি এলেও
দাম বেশ চড়া। টমেটো ১০০ টাকা কেজি। মাঝারি আকারের একটি ফুলকপির দাম ৫০
টাকা। মাঝারি আকৃতির বাঁধাকপি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। কাঁচা টমেটো প্রতি কেজি ৬০
টাকা। পিয়াজের পাতা ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে শিম বিক্রি
হচ্ছে প্রতি কেজি ৬০ টাকা। লাউ প্রতিটি ৫০ থেকে ৬০ টাকা। মুলার দামও প্রতি
কেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকা। বড় গোল বেগুন ৬০ টাকা। বাজারে সরবরাহ বাড়ায় নতুন
আলুর দাম কিছুটা কমেছে। আগের সপ্তাহে প্রতি কেজি ১০০ টাকা বিক্রি হলেও নতুন
আলুর কেজি ছিল ৬০ টাকা।
বাজারে আসা গৃহিণী সুলতানা বেগম বললেন, দুই
সপ্তাহ আগেও মাঝারি আকারের ফুলকপির দাম ছিল ৩০-৩৫ টাকা। শীতের সবজির দাম
এখন কমার কথা। কমার বদলে উল্টো হু হু করে দাম বাড়ছে। কেন বাড়তি দাম নেয়া
হচ্ছে এর কোনো যুক্তি খুঁজে পান না তিনি।
মাছের বাজারে সাইজ প্রতি
কেজি ইলিশ মাছ বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ১২০০ টাকা। প্রতি কেজি তেলাপিয়া
বিক্রি হয় ১৫০-১৬০ টাকা, রুই মাছ কেজি প্রতি ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা, কাতলা
২৮০-৩৫০ টাকা কেজি, শিং মাছ প্রতি কেজি ৪০০ টাকা, চিংড়ি প্রতি কেজি ৪৫০
থেকে ৬৫০ টাকা কেজি এবং টেংড়া প্রতি কেজি ৫৫০-৬০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
সেগুন
বাগিচা বাজারে আসা বেসরকারি কর্মকর্তা নয়ন বলেন, বাজারে প্রত্যেকটি
নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে জীবনযাপন করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। একটি
পণ্য কিনলে আরেকটি কেনার টাকা থাকছে না। মাস শেষে যে বেতন পাই তা দিয়ে
সংসারের জরুরি খরচ বাদ দিয়ে খাবারের জন্য যে টাকা রাখা হয়, তা দিয়ে পুরো
মাস চালাতে পারছি না।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের
(ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, নানা অজুহাতে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম
বাড়াচ্ছেন। তারা একবার দাম বাড়ালে কমানোর কোনো উদ্যোগ নেয় না। বাজার
নিয়ন্ত্রণে সরকারের একাধিক সংস্থা থাকলেও সেগুলো তেমনভাবে কার্যকর ভূমিকা
পালন করছে না। ফলে ভোক্তাদের নাভিশ্বাস বাড়ছে।